দুপুরের খাবার খেতে রুমে যাচ্ছি। রাস্তায় মানুষের প্রচুর ভীড়।হঠাৎ চোখ পড়ল হালকা পাতলা গড়নের একটি মেয়ের দিকে।চেহারাটা চেনা চেনা লাগছে।পরক্ষনেই মনে পড়লো শায়লার কথা।
আরে ও তো শায়লার মতো দেখতে।
কথা হলো না।দেখা হলো। নজর রাখলাম তার দিকে।
এভাবে দুই তিন ধরে দেখতে দেখতে কিছুটা নিশ্চিত হলাম। কথা বলতে ভয় হয়।কেউ আবার এসে যদি বলে ওই ব্যাটা হঠাৎ করে মেয়েমানুষ দেখলেই গায়ে পড়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয়?
তবুও একটু নিশ্চিত যেহেতু হয়েছি তাই জিজ্ঞেস করলাম আপু আপনার নাম কি শায়লা?
শায়লা আমাকে চেনে। ও আমাকে নোটিশও করেছে কয়েকবার। কিন্তু লজ্জায় আমাকে এড়িয়ে চলতে চায়।বলল হ্যাঁ মনিরুল ভাই আমি শায়লা।
চোখ দু’টো অশ্রুসিক্ত। সেদিন আর বেশি কথা হলো না।
শায়লা আমাদের গ্রামের মেয়ে।পড়াশোনাও করেছে মোটামুটি। একটি বাচ্চা মেয়ে আছে।আমি অনেক দিন যাবৎ একটি গার্মেন্টসে কাজ করি। আয়রন ম্যানের কাজ।খুব কষ্টের কাজ।যে টাকা বেতন পাই কোনমতে সংসার চলে।
আজকাল ওভারটাইমও নেই।অল্প টাকা বেতন।তারপরও বেতন নিয়ে নানানরকম ঝামেলা পোহাতে হয়।
নিত্যপন্যের মূল্য হু হু করে বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত।গরীব মানুষ দেশে থাকলেই কি না থাকলেই কী!
সাধারণ মানুষ নিয়ে রাজনীতি করে ক্ষমতায় আসে রাঘববোয়ালরা।সবাই লুটেপুটে খায়।আমার মতো শ্রমিকরা সবসময়ই কষ্টে জীবন যাপন করতে হয়।
বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার প্রথম উদ্দেশ্য ছিলো ঋণ থেকে মুক্তি নেওয়ার জন্য। কিন্তু এই স্বল্প আয় দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বলছিলাম শায়লার কথা।শায়লার স্বামী নিরেট ভালোমানুষ। এমনটাই বলেছিল শায়লার মা আমার পাড়া সম্পর্কের চাচি।মাঝে মাঝে ঈদের সময় বাড়িতে গেলে দেখা হতো।আমার কাছেও তেমন খারাপ মনে হয়নি ছেলেটাকে।গেরস্ত মানুষ।বাবার সাথে জমির কাজকর্ম করেই তার সংসার চালায়।
শায়লা অনেক সুন্দরী মেয়ে।এখনো তার সৌন্দর্যে মানুষ আকৃষ্ট হতে বাধ্য। কলেজে পড়াশোনা করেছে।অনেক বন্ধু বান্ধবী ছিলো শায়লার। মাঝে মাঝেই তাঁদের সাথে কথা বলত শায়লা।মুকিত এটা পছন্দই করতো না।মুকিত জমিজমা চাষাবাদ করলেও পড়াশোনা জানা মানুষ। বেশি পড়াশোনা করেনি।
একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম যখন বাড়িতে দেখা হয়েছিল।
সেদিন সে আমাকে বলছিলো ভাইজান বাংলাদেশে চাকরি করা খুবই কঠিন ব্যপার।নিজের আত্মীয় স্বজন কোন সম্মানীয় জায়গায় থাকলে অনেক সময় চাকরির সুযোগ আসে।অন্যথায় আরেকটা কারণে আসে সেটা হলো টাকা।
এসব বুঝতে পেরে পড়াশোনা আর সামনে এগোয়নি।
যাই হোক গ্রামের সরল সোজা একজন মানুষ। পড়াশোনা বেশি না করে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেছেন সেটা খারাপ না।
বিপত্তি বাঁধে শায়লার সাথে একটা বিষয় নিয়ে কারণ শায়লা তার বন্ধু বান্ধুবীর সাথে কথা বলে।বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে।
ফেসবুকে শায়লা খুব এক্টিভ।ভালো একটা ফলোয়ারও রয়েছে তার।সারাদিন ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে মুকিতের মা মানে শায়লার শ্বাশুড়িও রাগান্বিত হয় বারবার। শায়লা শোনার মেয়ে নয়।
ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দ্বন্দ্ব। শিমু।মুকিত আর শায়লার মেয়ে।বয়স মাত্র দশ মাস।ফুটফুটে একটি মেয়ে শিশু।খুব সুন্দর দেখতে।সবাই বলে মেয়েটি তার মায়ের মতো দেখতে।শায়লাও তো দেখতে বেশ সুন্দরী। শায়লা চায় স্বাধীনতা। শায়লা ভাবে সে বন্ধি জীবন অতিবাহিত করছে।
পৃথিবি যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন সে গাঁয়ের সেই তথাকথিত ঘরকোনে বউ হয়ে থাকতে চায় না।
মুকিতের পরিবার এসব লক্ষ্য করতে থাকে।তারাও ধীরে ধীরে শায়লার প্রতি অসন্তুষ্ট হতে শুরু করে।
একদিন মাঠ থেকে এসে মুকিত খাবার চাইলে শায়লা নিজে থেকে নিয়ে খাবার খেতে বলে। তখন মুকিত রেগে গিয়ে কষে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয় গালে।
শায়লা ভারতের একটি সিরিয়াল দেখছিলো বসে।খাবার দিতে গেলে তার দেরি হয়ে যাবে। সিরিয়াল শেষ হয়ে যাবে এমন চিন্তা থেকেই আসলে না করেছিল শায়লা।
শায়লা সন্ধ্যায় বাবার বাড়ি চলে আসে।আর স্বামীর বাড়ি যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় ।
এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন। তারপর মাস তারপর দেড়বছর চলে গেল।তারমধ্যে কয়েকবার গ্রাম্য শালিশও হয়েছে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি।
বউ পাগল মুকিত নিতে চাইলেও শায়লা যেতে রাজি না।অতএব তাদের ডিভোর্স হয়ে গেল।
ডিভোর্সি নারীদের অনেক সাফল্যের কাহিনী শায়লার জানা।কিন্তু নিজে সাফল্য ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিছুদিন বাবার বাড়ি থাকতে থাকল।কিন্তু নিজের বাবার বাড়িতেও তার সুখ সইলো না।ধীরে ধীরে কমতে থাকল শায়লার শান্তি।শায়লা বাড়ি থেকে চলে গেল ঢাকায়।ছোট্ট মেয়ে শিমু বাবার বাড়ি মুকিতের কাছে আদালতের রায় অনুযায়ী।
শায়লার দুঃখ তার মেয়ের জন্য মন কাঁদে। ইচ্ছে করলেই সে মেয়েকে দেখতে পারে না।
কিছুদিন আগেই এসব বলছিলো আরিফের মা।
আজকে যখন শায়লার চোখে জল দেখতে পেলাম তখন মনে হলো সব ঘটনা।
কত কষ্ট বুকে নিয়ে চলছে শায়লার জীবন।এখন শায়লা কাজ করে।গার্মেন্টসে লাইনম্যান, সুপারভাইজারের অশালীন ভাষা শুনে।মুখ বন্ধ করে কাজ করে ক্লান্তিহীন। কিছুদিন হেল্পারের কাজ করে এখন নাকি অপারেটর হয়েছে।
কাজের ভীষণ চাপ সে সামলায়। শায়লা এখন বুঝতে পেরেছে মেয়েরা স্বামীর ঘরেই সবচেয়ে সুখি।
ডিভোর্সের পরে প্রতি কদমে কদমে দুঃখের ছাপ লেগে থাকে।
সুন্দর চেহারার বলে ইতিমধ্যে কয়েকটা ছেলে শায়লার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে চায়।শায়লা এগগুলোতে সায় দেয় না।
ডিভোর্সের এতো বড় ইফেক্ট হয় সেটা সে আগে বুঝতে পারেনি। আবেগে পড়ে সে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সংসারকে আগে তার কাছে জেলখানা মনে হলেও এখন তার আর এমনটা মনে হয়নি। ওইদিকে মুকিত দ্বিতীয় বিবাহ করেছে বাবা মায়ের জোড়াজুড়ির কারণে। মুকিতের মেয়ে শিমু সৎ মায়ের সংসারে তেমন শান্তি পায় না। মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে।শায়লার বাবা শায়লাকে বিবাহ দিতে চায় কিন্তু শত চেষ্টায়ও তারা ব্যর্থ হচ্ছে। নানান কারণে বিবাহ ভেঙে যায়। যৌতুক হিসেবে প্রচুর অর্থ দাবি করে বরপক্ষ।শায়লার চোখে যেন লেগে আছে অনিশ্চয়তার এক স্বপ্ন। শায়লা তার জীবন সাজাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শায়লা তাঁর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কাটাচ্ছে তার প্রতিটি মুহূর্ত। একা ছুটে চলা কত কষ্টের তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে শায়লা। জীবন যুদ্ধে তবুও থেমে থাকতে রাজি নয় শায়লা।