বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এ চুক্তি সম্পন্ন হয়ে থাকে।পরস্পর একসাথে জীবন-যাপন করার জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে যে কার্যসম্পাদন করা হয় তাই হলো বিবাহ।
প্রত্যেক ধর্মেই বিবাহ একটি পূণ্যের কাজ।বিবাহের মাধ্যমে তৈরি হয় নতুন পারিবারিক সম্পর্ক।
পৃথিবীর শুরু থেকেই এই রীতি আমাদের সমাজে প্রচলিত।
বর্তমান সময়ে এই পবিত্র বন্ধনে ফাটল ধরা শুরু করেছে। আর সমাজ তার নাম দিয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ!
একটা আইনের মাধ্যমে বিবাহে আবদ্ধ দু’টি মানুষের আলাদা হওয়াকেই বিবাহ বিচ্ছেদ বলে।
বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিনদিন বেড়ে চলছে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা।
বিবাহ বিচ্ছেদ একটি সামাজিক ব্যধি হিসেবে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে সমাজে।
বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদ বর্তমানে ৩০ শতাংশের মতো।
এর মধ্যে নারীরাই সবচেয়ে বিবাহ বিচ্ছেদে আগ্রহী হিসেবে সমাজে লক্ষ্য করা যায়।
বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে সেগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো:
▪️পারস্পারিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ:
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে দু’জনের মধ্যে তৈরি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের।
যদি কোন কারণে এই পারস্পরিক বিশ্বাসে কোন ফাটল ধরে তাহলে বিচ্ছেদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে বিবাহের মত পবিত্র এই সম্পর্কগুলো।একজন অন্যজনকে দোষারোপ করতে থাকে আর নিজেদের মধ্যে নিজেদের শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে।পরিবারে শুরু বিভিন্ন ধরণের সমস্যা। একে অপরের কথা না শুনা।চাহিদার দিকে লক্ষ্য না রাখা। দায়িত্বের প্রতি অবহেলা ইত্যাদি শুরু হয়।তখন আলাদা হওয়ার একটি অবস্থা তৈরি হয়ে যায়।
▪️পারবারিক কলহ-বিবাদ :
বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো পারিবারিক কলহ-বিবাদ। আমাদের মা-বাবা, ভাই -বোন, দাদা-দাদি সবাইকে নিয়ে যৌথ পরিবার। এই পরিবারের সদস্যদের সাথে অনেক সময় কলহ-বিবাদের জের ধরেও বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনা ঘটে থাকে।
▪️যৌতুক প্রথা:
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যধি।বহুকাল ধরেই সমাজে এটি চলে আসছে নিরব ঘাতকের মতো।
সমাজে শিক্ষা বেড়েছে। বেড়েছে জনসচেতনতাও। কিন্তু এখনও কমেনি যৌতুক প্রথা।
যৌতুক নেওয়া ও দেওয়া দুটোই আইনত নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
পরিবার গরীব ও অসচ্ছল থাকলে মেয়ের বাবার উপর দেয়া হয় অসহনীয় চাপ যার ফলে শুরু হয় পরিবারে অশান্তি।
একসময় এই অশান্তিকে পুঁজি করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে থাকে।
যৌতুকের এই ভয়াবহতা মাঝে মাঝে নারীর জীবনও কেড় নিতে সক্ষম হয়।
▪পরস্পরের সময়ের অভাব:
সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো পরস্পরকে সময় না দেয়া।বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকবেন এটাই চির সত্যি ও স্বাভাবিক । কিন্তু অনেক সময় তা হয়ে উঠে না। বিশেষ করে চাকরিজীবী দম্পত্তির মধ্যে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ।তাই সেখানে সবাই কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে।অনেক সময় কর্মের কারণে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে দু’জনের মধ্যে।
এই যে সময়ের একটি দূরত্ব তা ধীরে ধীরে দুজনকে আলাদা করে দিতে সাহায্য করে।
কমতে থাকে দু’জন দু’জনের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ। সময়ের অভাবে একজন আরেকজন থেকে দূরে চলে যেতে থাকে।দু’জনের দূরত্ব বাড়ে আর এভাবেই একদিন বিচ্ছেদের দিকে অগ্রসর হয়।
▪️সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেভাবে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম সেভাবেই তা ধ্বংস করতেও সক্ষম ।
সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিনে দিনে বাড়ছে আমাদের সক্রিয়তা।
পরিবার থেকে আলাদা, সমাজ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি দিনদিন এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কারণে।
স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকছে কিন্তু একজন আরেকজন থেকে আলাদা। দু’জনেই ব্যস্ত তাদের মোবাইলে বা কম্পিউটার স্কিনে।
একজন ফেসবুকে আরেকজন হয়ত টিকটকের মত সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে।
নিজেদের মধ্যে সখ্যতা না গড়ে ওঠে সখ্যতা গড়ে ওঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোন বন্ধুর সাথে।
ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে অন্যদের প্রতি।শুরু হচ্ছে নিজেদের মধ্য কলহ-বিবাদের।অবশেষে পরিসমাপ্তি ঘটছে বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে।
বিবাহ বিচ্ছেদ কোন ক্রমেই উচিত নয়।বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়।
নিজেদের সন্তানের প্রতি তৈরি হয় অবহেলা।মা থেকে দূরে থাকার কারণে একটি সন্তান মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। আর তেমনিভাবে বাবার ভালোবাসা থেকেও।
মানুষের মনে বিভিন্ন ধরণের শঙ্কার তৈরি হয় যখন তারা পবিত্র বিবাহে আবদ্ধ হতে যায়।
ভয় ঢুকে যায় মনের গহিনে।
বিবাহ বিচ্ছেদ ঠেকাতে বাড়াতে হবে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ। তৈরি করতে হবে সামাজিক সচেতনতা।ধ্বংস করে দিতে হবে যৌতুকের মত সামাজিক ব্যধিকে।সবাই মিলেমিশে থাকার প্রতিশ্রুতি করতে হবে।পারিবারিক জীবনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বেশি সময় ব্যয় করতে হবে।
নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সন্তানদের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হতে হবে ।
লেখক : আরমান জিহাদ
লেখক ও ছড়াকার